অধ্যাপক রায়হান উদ্দিন :

অষ্টাদশ শতাব্দীর মধ্যভাগে বাংলাদেশে এক মহাবিপ্লবের সূত্রপাত হয়। উহার ফলে মাত্র সাত বছরের মধ্যে বাংলা, বিহার ও উড়িষ্যার গৌরব রবি চির স্থিমিত হয়ে পড়ে।১৭৫৬ খ্রী: নবাব আলীবর্দী খাঁ ইন্তেকাল করেন। তাঁর কোন পুত্র সন্তান ছিলনা তাই তাঁর জীবদ্দশায় বাংলার মসনদ নিয়ে নানা অসন্তোষ সৃস্টি হয়।একপক্ষ নওয়াব আলীবর্দী খাঁর ভ্রাতুষ্পুত্র ও জামাতা নওয়াজিস মুহাম্মদ খাঁ, অপরপক্ষে নওয়াব কন্যা আমিনার পুত্র সিরাজউদ্দৌল্লা। নওয়াজিস মুহাম্মদ খাঁর দাবী অপ্রতিরোধ্য করে তোলার জন্য তার স্ত্রী ঘসেটি বেগম সিরাজের কনিষ্ট সহোদর ইকরামউদ্দৌল্লাকে পোষ্যপুত্র হিসেবে গ্রহন করেন। কিন্তু কিছুকাল পর ইকরাম উদ্দৌল্লা পরলোক গমন করেন।তাহাদের অপর কোন সন্তান ছিল না। নওয়াজিস এর প্রভাব প্রতিপত্তি ছিল। হঠাৎ তারও মৃত্যু হয়। ঘসেটি বেগম কিছুকাল তার ষড়যন্ত্র থেকে দুরে থাকলেও ষড়যন্ত্রের বীজ তিনি বপন করেছিলেন, যা পরবর্তীতে মহিরুহে পরিণত হয়ে সিরাজের মাথায় ভেঙ্গে পড়ে।এই ষড়যন্ত্রে প্রথম থেকে ইংরেজ বণিকদল বারিসিঞ্চন করে আসছিল। নওয়াজেসের মৃত্যুর পর নওয়াব আলীবর্দীখাঁর বৈমাত্রেয় ভগ্নির স্বামী মীর জাফর আলী খাঁকে কেন্দ্র করে এই ষড়যন্ত্র ধুমায়িত হতে থাকে। একমাত্র দেওয়ান মোহন লাল ব্যতিত একে একে সকলে ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হন। পলাশীর প্রান্তরে সিরাজের অপ্রত্যাশিত পরাজয়ের পর একে একে সকলে সিরাজকে ত্যাগ করেন।এমনকি রাজধানী হতে গোপনে পলায়নের কথা দুরে থাক সিরাজের শশুর ফিরোজ খাঁ পর্যন্ত সিরাজের সাথে যেতে অস্বীকার করেন। শুধুমাত্র এই মহা সংকটের সময় একমাত্র পতিপ্রাণা লুতফুন্নেছা সমস্ত বিপদকে স্বেচ্ছোয় বরণ করে নিয়েছিলেন। লুতফুন্নেছার পিতার নাম ছিল ফিরোজ খাঁ । অনেকের মতে তাাঁহার নাম পিরিচ খাঁ। ফিরোজ খাঁর বংশ পরিচয় সম্পর্কে তেমন কিছু জানা যায়না। সংসারের ব্যয় নির্বাহের জন্য অতিকষ্টে তিনি নবাব আলী বর্দী খাঁর দরবারে একটি ছোট্ট চাকরীর ব্যবস্থা করে নেন।তখন তাঁর মেয়ে লুতফুন্নেছার বয়স ছিল ১২ বছর।অতি অল্পসময়ের মধ্যে লুতফুন্নেছা নওয়াব পত্নী শরফুন্নেছা দৃস্টি আকর্ষণ করেন।ভুবনবিখ্যাত নুরজাহান যেমন বাদশাহ আকবরের অন্ত:পুরে পরিচারিকার কাজ করতে গিয়ে শাহজাদা সেলিমের দৃস্টি আকর্ষন করেছিলেন ঠিক তদ্রুপ লুতফুন্নেছাও সিরাজের দৃস্টি আকর্ষন করলেন। সিরাজের অনেক অনুনয় বিনয়ের পর শরফুন্নেছা বিবাহে সম্মতি প্রদান করেন।বিবাহের পর সিরাজ হিরাঝিল প্রাসাদে অবস্থান করেন। হীরাঝিল প্রাসাদের অন্য নাম ছিল মনছুর গঞ্জ প্রাসাদ। সিরাজের একটি উপাধি ছিল মনসুর উল মুলক্।

১৭৫৬ খ্রী:  নওয়াব আলীবর্দী খাঁ ইন্তেকাল করেন। তাঁর কোন পুত্র সন্তান না থাকায় সিরাজ বাংলা বিহার উড়িষ্যার সুবাদার হন। এদিকে সিরাজ সিংহাসনের উত্তরাধিকারী মনোনীত হওয়ায় ষড়যন্ত্র চলতে থাকে। ইষ্ট ইন্ডিয়া কোম্পানীর ইংরেজরা দিল্লীর বাদশার দেওয়া শর্ত ভঙ্গ করে চলতে থাকে। সিরাজ তাদেরকে একাধিকবার সতর্ক করেন। এর পর সিরাজ কাশিমবাজার কুঠীর এর গোমস্তা ওয়াটসকে বন্দী করে নিয়ে আসেন।ওয়াটস এর পত্নীর অনেক কান্নাকাটি ও অনুনয় বিনয়ের পর সিরাজ মাতা আমিনা বেগম তাদের একমাস হিরাঝিল প্রাসাদে থাকতে দেন।এমনকি লূতফুন্নেসার অনুরোধে সিরাজ ওয়াটসকে মুক্তি দেন। এই নিমক হারাম ওয়াটসই পরবর্তীতে সিরাজের বিরুদ্ধে সকল ষড়যন্ত্রের যোগাযোগ রক্ষাকারীদের একজন হয়েছিলেন।

১৭৫৭ সালের ২৩ শে জুন বাংলার ইতিহাসে সবচেয়ে স্মরনীয় দিন।এই দিন পলাশীর প্রান্তরে বিশ্বাসঘাতক সেনাপতি মীর জাফর আলী খাঁ, সেনাপতি রায় দুর্লভ রাম, সেনাপতি ইয়ার লতিফ খাঁ, জগৎশেট মাহতাব চাঁদ, তার ভ্রাতা মহারাজ স্বরুপচাঁদ, দেওয়ান রাজবল্লভ, রাজা মানিক চাঁদ,মহারাজা নন্দ কুমার, আমিন চাঁদ প্রভৃতির ষড়যন্ত্রে সিরাজ ইংরেজ সেনাপতি রবার্ট ক্লাইভের নিকট একরকম বিনাযুদ্ধে পরাজিত হয়ে রাজধানী রক্ষার জন্য সন্ধ্যার একটু পরে মুর্শিদাবাদ পৌছেন।অথচ কথিত আছে সিরাজের অসংখ্য সৈন্য ইংরেজদের যদি একটি একটি পাথর ছুড়ে মারতেন তাহলে ইংরেজদের শোচনীয় পরাজয় হতো। অথচ একমাত্র ষড়যন্ত্রের কারনে সিরাজের পক্ষের কেউ অস্ত্র ধরে নাই। এদিকে রাজধানীতে পৌছার আগেই অনেকে ইংরেজ সৈন্যের ভয়ে নগর ত্যাগ করে যাচ্ছে।সিরাজ সবাইকে নগর রক্ষার আহবান জানালেন। কিন্তু শত্রু সৈন্য উল্লাস ধ্বনীসহ নগর কন্ঠে এসে যাওয়ায় সিরাজ তৎক্ষণাত নগর ত্যাগের সিদ্ধান্ত নিলেন। লুতফুন্নেছা সহ সিরাজ চারিবছরের কন্যা জোহরা, একটি পরিচারিকা ও একটি ভৃত্য সহ নিশীথের গাঢ় অন্ধকারে রাজমহলের উদ্দ্যেশ্যে হিরাঝিল ত্যাগ করেন। এদিকে সিরাজকে ধরে আনার জন্য মীর জাফর লোক জন পাঠিয়েছিলেন। সিরাজের নৌকা রাজমহল হতে কিছু দুরে অবস্থান কালে পরিশ্রমজনিত কারনে মাঝি মাল্লারা নৌকা নোঙ্গর করে। অদুুরে একটি ভগ্নপ্রায় মসজিদ দেখে সিরাজ স্ত্রী কন্যা সহ সেখানে রাত্রি যাপনের ব্যবস্থা নেন। মসজিদের মোতয়াল্লি দানিশ শাহ সিরাজকে চিনতে পেরে গোপনে মালদহের ফৌজদার দাউদ খাঁকে সংবাদ পাঠান। জুলাই মাসের দুই তারিখে জাফর আলীর জামাতা মীর কাসিম আলী খাঁ সিরাজকে স্বপরিবারে বন্দী করে মুর্শিদাবাদে নিয়ে আসেন। মসজিদের মোতয়াল্লী গোপনে সংবাদ পাঠানোর জন্য প্রচুর উপটৌকন পেয়েছিলেন। সেই রাত্রেই মীর জাফর পুত্র মীরনের আদেশে সিরাজের পিতার অন্নজলে পালিত মুহম্মদী বেগের তরবারির আঘাতে সিরাজের মস্তক দেহ হতে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে। খোশবাগে নওয়াব আলীবর্দী খাঁর কবরের পুর্বপার্শ্বে সিরাজকে সমাহিত করা হয়।সিরাজের কবর সংলগ্ন আরেকটি কবর হলো তার কণিষ্ঠভ্রাতা মীর্জা মেহদীর। মীর জাফরের আদেশে এই সুদর্শন পঞ্চদশ বয়স্ক বালককেও হাতির পায়ে পিষ্ট করে মারা হয়।এটি সংঘটিত হয় সিরাজের মৃত্যুর কয়েকমাস পরে।

মীর জাফর আলী খাঁ আলীবর্দীর মহিষী শরফুন্নেছা, কন্যা ঘসেটি বেগম, আমিনা বেগম, সিরাজ পত্নী লুতফুন্নেছা এবং কন্যা জোহরাকে কিছুকাল মুর্শিদাবাদে রেখে পরে ঢাকায় নির্বাসিত করেন। উল্লেখ্য সিরাজের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রে ঘটেটি বেগম প্রথম দিকে অংশ গ্রহন করলেও পরবর্তীতে সিরাজের নৃশংস হত্যাকান্ডের পর তাঁর মনোভাবের পরিবর্তন ঘটে।এমনকি জানা যায় তিনি নাকি মীর জাফর আলীর বিরুদ্ধেও একটি ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হয়েছিলেন। এই অপরাধেই বোধহয় মীরজাফর তাঁকে কারারুদ্ধ ও ঢাকায় নির্বাসনে পাঠান। দুরে নির্বাসনে পাঠিয়েও মীরজাফর শান্তিতে ছিলেন না । কখন কোথায় কার সাহায্য লইয়া আবার পতন ঘটান এই চিন্তায় তার ঘুম হতো না। তাই নরহত্যা বিশারদ মীরনের সাহায্যে তাঁদের পৃথিবী থেকে চিরতরে বিদায় দেওয়ার জন্য মীর জাফর চেষ্টায় ছিলেন। জেসারৎ খাঁ তখন ঢাকায় শাসনকর্তা ছিলেন। তিনি মীর জাফরের নিকট আত্মীয় । জেসারত খাঁকে পর পর চিঠী লিখে বিফল হয়ে মীরণ ব্যর্থ হয়।অবশেষে মুর্শিদাবাদ হতে কয়েকজন লোক পাঠিয়ে ঘসেটি বেগম ও আমেনাবেগমকে পদ্মাবক্ষে ডুবিয়ে মারা হয়।সিরাজ তনয়া জোহরা সম্পর্কে প্রবাদ আছে যে, মীরণের প্রেরিত অনুচরেরা মিষ্টান্নের সহিত গোপনে বিষ মিশ্রিত করে উহা বেগম শরফুন্নেছা ও লুতফুন্নেছা এবং সিরাজ তনয়া জোহরার জন্য পাঠিয়ে দেয়। শরফুন্নেছা ও লুতফুন্নেছা রোজা ছিলেন বিধায় তাঁহাদের অংশটা তুলিয়া রাখিয়া দিয়াছিলেন। বাকি অংশ সিরাজ তনয়া ভক্ষন করার সাথে সাথে মুত্যু বরন করেন।

মীরণের এই দুস্কর্মের সংবাদ চারিদিকে ছড়িয়ে পড়লে মুখরক্ষার মানসে ইংরেজরা লুতফুন্নেছা এবং শরফুন্নেছাকে মুক্তির ব্যবস্থা করে মুর্শিদাবাদে ফিরিয়ে আনা হয়। ইংরেজদের নির্দ্দেশে মীরজাফর শরফুন্নেছা ও লুতফুন্নেছার জন্য যথাক্রমে ৩০০ এ্বং ১০০ টাকা বৃত্তির ব্যাবস্থা করেন।শোকে দু:খে শরফুন্নেছার স্বাস্থ একেবারে ভেঙ্গে পড়েছিল। বেগম লুতফুন্নেছা আহার নিদ্রা ভুলিয়া তাঁহার সেবাশুশ্রষায় নিয়োজিত ছিলেন। মুর্শিদাবাদ পৌছার পরে তিনি পরলোক গমন করেন। খোশবাগে তাঁকে সমাহিত করা হয়।তাঁর মৃত্যুর পর বেগম লূতফুন্নেছার আপন বলতে আর কেউ রইলনা। তাঁর সাথে ছায়ার মতো দুইজন পরিচারিকা ছাড়া আর কেহ ছিল না।বৃত্তির একটা বড় অংশ তিনি সিরাজের আত্মীয় স্বজনদের মঙ্গলের জন্য দান করিতেন।অবশিষ্ট অর্থে কোন দিন আহারের ব্যবস্থা হতো আর কোনদিন হতো না।

খোশাবাগের সমাধি গুলির দেখাশুনার দায়িত্ব শরফুন্নেছার উপর অর্পিত হয়েছিল। এ কাজের জন্য তাঁকে মাসিক ৩০০ টাকা প্রদান করা হতো। শরফুন্নেছা খোশাবাগ কবরের কাছে একটি পর্ণকুঠির নির্মান করে তাতে আজীবন বাস করেন। সমাধি দেখাশোনার জন্য যে টাকা পাইতেন তার বেশীর ভাগ তিনি প্রতিবেশী গরীব দীন দু:খী ও মওলবীগনের মধ্যে বিতরন করে দিতেন।সকাল সন্ধায় বোরখা পড়ে স্বামীর কবরের পার্শ্বে বসে কোরআন পাঠ করতেন।সারা বছর তিনি রোজা রাখতেন এবং অধিক রাত্রি পর্যন্ত আল্লার ধ্যানে মশগুল থাকতেন।পাশ্ববর্তী গ্রামের লোকেরা তাঁকে “বেগম আম্মা ”বলে ডাকতেন এবং তাঁহার আর্শীবাদের জন্য কুঠির প্রাঙ্গনে ভীড় করতো।প্রত্যেক বৃহস্পতিবার সন্ধায় ্এবং মুসলমানদের পর্ব এবং হিন্দুদের পুজা উপলক্ষে এখানে এতো লোক সমাগম হতো যে তা মেলার মতো দেখাতো। দুর দুরান্ত হতে হতাশাগ্রস্ত অনেক রোগী তাঁর কাছে আসতো। তিনি আরোগ্যের জন্য আল্লার কাছে করুন আবেদন জানাতেন। জীবনের শেষ পর্যন্ত তিনি কারো সাথে স্বামী কিংবা আত্মীয় স্বজনের ব্যাপারে আলাপ করেন নাই। নীরবে অশ্রু ফেলতেন।খুব সম্ভব ১৭৮৩ খৃী: কোন এক সময় এই বিদুষী মহিলা মৃত্যুর ক্রোড়ে আশ্রয় লাভ করেন।

অধ্যাপক রায়হান উদ্দিন

জীবদ্দশায় তিনি বিশ্বাসঘাতক মীর জাফর আলী খাঁকে কুষ্টরোগের অসহ্য যন্ত্রনায়, মীরণকে দিন দুপুরে প্রখর সূর্যালোকে বজ্রাঘাতে, জগৎ শেঠ মাহতাব চাঁদকে ও মাহরাজ স্বরুপ চাঁদকে মুঙ্গেরের কারাগার প্রাচীর হইতে নদীতে নিক্ষিপ্ত হইয়া, মহারাজ নন্দকুমারকে ফাঁসির কাষ্টে, রাজা রাজবল্লভকে বন্দীদশায়, আমিন চাঁদকে নি:স্ব অবস্থায় শৃগাল কুকুরের ন্যায় এবং অন্যান্যকেও অনুরুপভাবে মৃত্যুবরন করে পাপের প্রায়শ্চিত্ত করতে দেখা গেছে। কে বলতে পারে এই সতী সাধ্বী মহিলার অভিশাপে ইহাদের এহেন দুর্দশা হয় নাই। লুতফুন্নেছার অন্তিম ইচ্ছানুসারে তাঁকে সিরাজের পায়ের কাছে দাফন করা হয়। এখনও স্থানীয় অধিবাসীরা তাঁহার দোয়া চেয়ে গ্রামের লোকজন তথায় সিন্নি দিয়ে থাকে।